শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৯:৩৮ অপরাহ্ন

মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল

মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল

নাসিম আহমদ লস্কর: শহীদুল জহির বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। সত্তরের দশকের শেষ দিকের এ লেখক আপন লেখনীর ম্যাজিক দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন প্রথাগত লেখনী জগতের বাইরে অন্য এক স্বতন্ত্র জগতে। তার লেখনীতে ফুটে উঠেছে জীবন বাস্তবতা, দেশের কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা ও সেই সঙ্গে মানবমনের অন্তর্দাহের কথা। বলা হয়ে থাকে, ‘হুজুগে বাঙালি কিছুদিন পর সবকিছু ভুলে যায়।’ কিন্তু তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে এ কথা যে ভুল এবং বাংলার আপামর জনসাধারণ যে আত্মসচেতন সেই কথাটি ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। জনসাধারণের মনের অব্যক্ত সত্যগুলো তিনি বের করে এনেছেন বিভিন্ন চরিত্রের ভেতর দিয়ে। ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ তার সুনিপুণ হাতে রচিত এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাস গ্রন্থ। উপন্যাসের সারসংক্ষেপ এভাবেই বলা যায় যে, তিনি গ্রন্থটিতে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন পাক হানাদারদের তা-বললীলার কাহিনী, সাধারণ বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী চেতনার কাহিনী। পাশাপাশি তিনি আরও ফুটিয়ে তুলেছেন ক্ষমতার লোভে কিছু পথভ্রষ্ট বাঙালির বিকৃত মানসিকতার কথা। ফুটিয়ে তুলেছেন ধর্মব্যবসায়ীদের ধর্ম ব্যবসার কথা।
উপন্যাসটিতে অনেক চরিত্র রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চরিত্র হলো আবদুল মজিদ, বদু মওলানা, মোমেনা, আজিজ পাঠান। বাকি চরিত্রগুলো প্রকৃতপক্ষে পুরো কাহিনীটিকে সুনিপুণভাবে সাজানোর জন্য পার্শ চরিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিল।
উপন্যাসের নায়ক আবদুল মজিদ ছিল স্বাধিকার চেতনায় বিশ্বাসী এক বাঙালি তরুণ। ১৯৮৫ সালে যখন রাজাকার বদু মওলানার ছেলে আবুল খয়ের হরতাল পালনের জন্য জনসাধারণকে মাইকিং করে ধন্যবাদ জানায় তখন সে ফিরে যায় ১৫ বছর আগের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে আবুল খয়েরের পিতা বদু মওলানার পাকিস্তানি মিলিটারিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তা-বলীলা চালানোর নগ্ন দৃশ্য। বদু মওলানা ছিল তৎকালীন সময়ের এক ঘৃণ্য রাজাকার। পুরুষ হত্যা অর নারী ধর্ষণে সে ছিল পাকিস্তানি মিলিটারিদের সহযোগী। ধর্মের দোহাই দিয়ে সে এসব অপকর্ম চালাত। অথচ, ’৭১ সালে লক্ষ¥ীবাজারে প্রথম যে লোকটি নিহত হয়েছিল সে ছিল মুসলমান। গ্রামে যত হত্যা, ধর্ষণসহ নানা রকম অপকর্ম সংঘটিত হয়েছিল সবই হয়েছিল তার আঁতাতে। গ্রামে মানুষের লাশ আর নারীদের ধর্ষণ দেখে তার হƒদয় এতটুকু কেঁপে উঠেনি। কিন্তু তার ছেলে বাশারের কুকুরটি মিলিটারিদের হাতে মরে যাওয়ার কারণে সে তার হিংস্রতা আর পশুত্বে ভরা হƒদয়ে খুব আঘাত পেয়েছিল। কতটা হিংস্র হলে মানুষ এ রকম বিবেকবর্জিত হিংস্র পশু হয়ে উঠতে পারে তা ভাবতেও গাঁ শিউরে ওঠে। ধর্মের লেবাসের আড়ালে সে ছিল এক হিংস্র ঘৃণ্য পশু।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত বেশির ভাগ গল্প-উপন্যাসে কেবল মুক্তিযুদ্ধকালীন করুণ সময়ের বর্ণনা করা হয়েছে। লেখক এ বইটিতে মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী সময়ের বাস্তব চিত্র সুনিপুণভাবে অত্যন্ত সূক্ষ¥ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বস্তুত, এভাবেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নারকীয় তা-বলীলা সংঘটিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগে কিছু অতি উৎসাহী লোকের ইন্ধনে স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত শক্তিরা মানবতার আলখাল্লা পরিধান করে স্বাধীন বাংলায় আবার ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও তারা সময়ের বিবর্তনে আসতে পেরেছে তবুও তারা এখনও নিঃস্বার্থ বাঙালিদের কাছে চরম ঘৃণার পাত্র।
এটি পাঠে মনে হলো যে, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বইটি মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী সময়ের এক সুনিপুণ দলিলপত্র। লেখকের শাণিত চিন্তা-চেতনা বইটিকে এক সুউচ্চ স্থানে নিতে সক্ষম হয়েছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877